।।আমজাদ হোসেন।।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধনিক শ্রেণি ও ক্ষমতাসীন মানুষের দ্বারা সাধারণ মানুষ হয়েছে নির্যাতিত নিষ্পেষিত। ইউরোপীয় ইংরেজরা প্রায় সম্পূর্ণ পৃথিবীকে রূপান্তরিত করেছে তাদের কলোনিতে। তাদের এই কলোনি টিকিয়ে রাখার জন্য সাধারণ মানুষের ওপর করেছে মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার, অবিচার; চালিয়েছে শাসনের স্ট্রিম রোলার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভারতবর্ষে আগমন করেছিল তথাকথিত শিক্ষিত উন্নত ব্যবসায়ী ব্রিটিশরা । ওরা কলোনিতে রূপান্তরিত করেছিল ভারতবর্ষকে।
নির্যাতনের পূর্ণতাদানের জন্য সৃষ্টি করেছিল সামন্তবাদ প্রথা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে মধ্যসত্তাভোগী সৃষ্টি করে সাধারণ ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ শোষণের পথ আরও নিশ্চিত করেছিল ওরা। পাশাপাশি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নির্যাতিত হয়েছে নারী সমাজ। লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কারের বেড়াজালে নিষ্পেষিত হয়েছে নারী জাতি। আর এসব জ্বালা যন্ত্রণা থেকে মানব জাতিকে মুক্তির অমীয় বার্তা শোনানোর জন্য বাংলা সাহিত্যে আবির্ভুত হয়েছিলেন মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি দুঃখ দারিদ্র্যতাকে অবলোকন করেছেন অনেক কাছ থেকে।
তাই তো দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত সাধারণ মানুষের কথা উঠে এসেছে এই মহান কবির সাহিত্যকর্মে । সাম্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন অকপটে। সুশৃঙ্খল সমাজ ব্যবস্থা নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলার প্রথম ও প্রধান নিয়ামক শ্রমিক শ্রেণির মানুষ। অথচ এই শ্রমিকদের উপর কী অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে মালিক বা মুনিবগণ। একজন শ্রমিক হিসেবে, অভাবী মানুষ হিসেবে তা তিনি দেখেছেন ও অনুভব করেছেন খুব কাছ থেকে।
কবি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেন নি এই সাধারণ মানুষের প্রতি শোষণ ও বঞ্চনা। তাই তিনি আজীবন লেখা-লেখি করেছেন এই বঞ্চিত শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। মুক্ত করতে চেয়েছেন এই মাতৃভূমিকে। যার কারণে তাঁকে লিখতে হেয়েছে নির্যাতনকারী ব্যক্তিবর্গ ও মহলের বিরুদ্ধে। ধর্মকে ব্যবসার পসরা বানিয়েছেন যারা, ক্ষমতাকে যারা ব্যবহার করেছেন শোষণের হাতিয়ার হিসেবে তাদের বিরুদ্ধেই কাজী নজরুল ইসলাম রূপ নিয়েছেন বিদ্রোহীর। আর সর্বসাধারণের কাছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রেমের কবি, সাম্যের কবি। তার ‘আনন্দময়ীর আগমনে’কবিতায় শাসকদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হওয়ায় কারাবরণ করতে হয়েছে কবিকে। সহ্য করতে হয়েছে আঘাত, যন্ত্রণা; তবুও তিনি পিছপা হননি। আর্তমানবতার মুক্তির জন্য আজীবন লেখার মাধ্যমে সংগ্রাম করেছেন এই মহান কবি ।
একবিংশ শতাব্দীর এই আধুনিক যুগে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনার জয় হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক সকল মানুষের অধিকার। গণতান্ত্রিক অধিকার, শিক্ষার অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার, ধর্মীয় অধিকারসহ জীবনের প্রতিটি পর্বে মানুষ হয়ে সম্মানের সাথে সবাই বেঁচে থাকুক নজরুল দর্শনে, নজরুলের সাম্যে। শুধু কথায় নয়, আলোচনায় নয়, সেমিনার আর র্যালিতে নয়, বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হোক নজরুলের সাম্যবাদ । কাজী নজরুল ইসলামের ১২৬ তম জন্ম দিনে তাঁর সাহিত্যকর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই।
লেখক: সহকারী শিক্ষক (বাংলা), ফরিদপুর উচ্চ বিদ্যালয়
Leave a Reply