।।আসাদ জামান।।
৭ জানুয়ারি, ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিমায় চিৎকার করছেন নজরুল।
শান্ত ও ধ্যান গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে অমন করে চিৎকার করা বা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে চেঁচানো যে কারও জন্য বেমানান ছিল, তবুও নজরুল স্বভাবসুলভ আচরণে সেদিন তা করে দেখিয়েছিলেন। অথচ জোড়াসাঁকো পুরো বাড়িটাই ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর আর রমণীয়। বাঘা বাঘা লোক, পণ্ডিত-মনীষী সংযতভাবে ওই বাড়িতে ঢুকতেন, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলার সময়। কেউ কখনো একটু সময়ের জন্যও অসংলগ্ন আচরণ করতেন না। চিৎকার চেঁচামেচি তো দূরের কথা।
নজরুল সেদিন ঠাকুর বাড়ির এই শান্ত সমাহিত নীরব পরিবেশ ভঙ্গ করে অকম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে গুরুজি, আপনাকে হত্যা করব, ইত্যাকার দম্ভোক্তি করে মহা হুলুস্থূল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটু বিরক্ত বা বিব্রতবোধ করেননি, বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হননি।
নজরুল একদিন বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তার বিদ্রোহে একদিন জগৎ আলোকিত হবে— রবীন্দ্রনাথের তা জানা ছিল। তা নাহলে এই চাল চুলোহীন, অর্ধশিক্ষিত, গোয়ার, বোহেমিয়ান যুবককে অত্যধিক স্নেহ-যতœ করবেন কেন রবীন্দ্রনাথ? তিনি নজরুলের মধ্যে আবিষ্কার করেছিলেন নির্ভীক ব্যক্তিত্ব, অনমনীয় আত্মপ্রত্যয়, দুর্জয় অহংবোধ এবং অবিসংবাদিত দেশপ্রেম। তাই নজরুলের এসব উৎপাত রবীন্দ্রনাথ সব সময় সহ্য করেছেন, মেনে নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিদ্রোহী কবিতাটি শুনিয়ে দিলেন- যা আগের দিন ছাপা হয়েছে বিজলী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সেদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের মিলন মুহূর্তটি সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কারণ, নজরুল জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৩৮ বছর পরে। সময়ের এই দূরত্বটা বেশ বড়। অবস্থাগত দূরত্বটা ছিল আরও বেশি প্রসারিত। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়। ঠাকুর পরিবারের আদি-কর্তারা ভূমির খাজনা ও ব্যবসা থেকে প্রচুর বিত্ত অর্জন করেন। কলকাতা শহরে রবীন্দ্রনাথের পিতামহের একাধিক বাড়ি, অফিস, বাগানবাড়ি ছিল। পিতামহের দপ্তরে ইংরেজ ম্যানেজারও কাজ করত। পিতামহ বিলেতে গেছেন দু’বার। প্রথমবার গিয়ে চোখ-ধাঁধানো এত খরচপাতি করেন যে, তাকে ‘রাজপুত্র’(প্রিন্স) উপাধি দেওয়া হয়। দ্বিতীয়বার যাবার পর আর দেশে ফিরে আসেননি। বিলেতে মৃত্যু হলে সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ছিল শিল্পচর্চার একটি প্রধান কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের সময়ে ওই বাড়ি থেকে একাধিক পত্রিকা বের হতো। সঙ্গীতের চর্চা ছিল নিয়মিত। বাড়ির মঞ্চে নাটক মঞ্চস্থ হতো। পরিবারের সদস্যরা লিখতেন, অভিনয় করতেন, আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথের উপাধি ছিল মহর্ষি। তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নামের গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী তার ব্যবস্থাপনাতেই বের হতো। রাজনৈতিক মেলাও এখানে বসত। শান্তিনিকেতনে তাদের পৃথক পারিবারিক আশ্রম ছিল, বিস্তীর্ণ জমিদারী ছিল পূর্ববঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ পিতামাতার চতুর্দশ সন্তান। বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন দার্শনিক ও বিজ্ঞানী। মেজ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন প্রথম ভারতীয় আইসিএসদের একজন। রবীন্দ্রনাথের বোনদের একজন ছিলেন ঔপন্যাসিক ও পত্রিকার সম্পাদক, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রথম যে অল্প কয়েকজন মহিলা উপস্থিত ছিলেন তিনি তাদের একজন। ঠাকুর বাড়ির পুত্রবধূ ও মেয়েরা পোশাকে নতুন রীতি উপস্থিত করেছিলেন। স্বামীর সঙ্গে কেউ কেউ গড়ের মাঠে যেতেন ঘোড়ায় চড়ে। রবীন্দ্রনাথের জন্য খুব উপকারে এসেছিল তার ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বন্ধুত্বপূর্ণ সাহচর্য। এই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সমবয়স্ক এবং তাঁর সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে সহযোগী।
অপরদিকে নজরুলের পারিবারিক পটভূমিতে এ ধরনের কোনো সুযোগ ও সুবিধাই ছিল না। তাঁর জন্ম বিহার সংলগ্ন প্রান্তিক, অত্যন্ত অনগ্রসর এক এলাকায়। ভূমিষ্ট হয়েছিলেন যে গৃহে সেটি ছিল খড় দিয়ে ছাওয়া এবং মাটির তৈরি। নয় বছর বয়সে তিনি তাঁর পিতাকে হারান। পিতার নাম কাজী ফকীর আহমদ, যে নাম আভিজাত্যের দ্যোতক নয়। তাঁর নিজের নাম দেওয়া হয়েছিল দুখু মিয়া। কারণ, পরিবারে অভাব ছিল সুখের এবং সন্তানেরা বাঁচতও না। জীবিকার জন্য শৈশবেই নজরুলকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। মসজিদের মোয়াজ্জিন, দরগার মোতাল্লির কাজ তিনি করেছেন। লেটোর দলে যোগ দিয়েছিলেন। রুটির দোকানে চাকরি করেছেন। নিজের বাড়ি থেকে অনেক দূরে ময়মনসিংহের এক দারোগার বাড়িতে কিছু কাল থেকেছেন। কাজীরা মোগল আমলে হয়তো বিচারক ছিলেন। তাদের পরিবারে আরবি-ফার্সির চর্চা থাকবার কথা। নজরুলের কালে সেসবের চিহ্ন কিছু ছিল। যে বাঙালি মুসলমান সমাজে নজরুলের জন্ম, সেটিও প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের তুলনায় ছিল কমপক্ষে পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে।
স্কুলের পড়াতে রবীন্দ্রনাথের কোনো আগ্রহ ছিল না। নজরুলও স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেননি। কিন্তু স্কুল ছেড়ে অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথ গেছেন বিলেতে। একবার নয় দুইবার। প্রথমবার ছিলেন দেড় বছর। ভর্তিও হয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কলেজে। দ্বিতীয়বার ছিলেন তিন মাস। আর নোবেল পাওয়ার পর গোটা পৃথিবী চষে বেড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্যদিকে নজরুলের দৌড় ওই করাচি পর্যন্ত। নিজ শহর কলকাতার বাইরে করাচি, ঢাকা, চট্টগ্রামই ছিল তার দূরের শহর। তবে হৃদয়ে তিনি গোটা পৃথিবীকেই ধারণ করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সারা দুনিয়ার নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের কবি।
সবদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের ব্যবধানটা ছিল বিস্তর। আসলে নজরুলের মতো অবস্থা থেকে এর আগে বা পরে বাংলা সাহিত্যে অত বড় মাপের কোনো কবির অভ্যুদয় ঘটেনি— এ বিষয়টির স্বীকৃতি প্রথম রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন নজরুল। সেই স্বীকৃতির প্রথম মঞ্চায়ন হয় ১৯২২ সালের ৭ জানুয়ারি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের আনন্দে উদ্বেলিত নজরুলকে বুকে টেনে নিয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবির স্বীকৃতি দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরের দিন জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্র-নজরুলের যে ‘মহামিলন’ সেটিই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়। এর সাড়ে পাঁচ মাস আগে অর্থাৎ ১৯২১ সালের ২০ জুলাই ওই জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতেই তাদের প্রথম দেখা হয়েছিল— জীবনীকারদের বর্ণনায় এমনটিই উঠে এসেছে।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২০ সালে কলকাতায় এসে পুরোপুরি সাহিত্য চর্চায় মগ্ন হন। ওই সময় থেকে কলকাতার ‘প্রবাসী’, ‘ভারতী’, ‘মোসলেম ভারত’, ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, ‘নবযুগ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রকাশ হতে থাকে। বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায়ও নজরুল নিয়মিত যেতেন। রবন্দ্রীনাথের ব্যক্তিগত সচিব সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর কবিতাও ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় বের হত। ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের কবিতা সুধাকান্ত মারফত পড়তেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল সম্পর্কে নিজের আগ্রহের কথা প্রকাশ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও অনেকের কাছে। তাদের কাছে বিষয়টি জানতে পেরে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন নজরুল। অবশেষে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যান নজরুল। দিনটি ছিল খুব সম্ভবত ১৯২১ সালের ২০ জুলাই। সেদিন রবীন্দ্রনাথের সৌম্য, শান্ত, জ্যোতির্ময় মূর্তি দেখে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে যান নজরুল। বিষ্ময়ের ঘোরে নজরুল কোনো কথাই বলতে পারেননি সেদিন।
এরপর থেকে তাদের উভয়ের দেখা-সাক্ষাৎ, চিঠি-পত্র আদান-প্রদান হতো নিয়মিত। চিঠি-পত্রে এবং ব্যক্তিগত সম্বোধনে নজরুল রবীন্দ্রনাথকে ‘গুরুজি’ বলতেন। রবীন্দ্রনাথও নজরুলকে অকাতরে স্নেহ সুধা ঢেলে দিতেন। সহ্য করতেন নানা উৎপাত।
প্রথম দেখার দুই মাস পর ১৯২১ সালের অক্টোবরে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নজরুলের। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পূজার ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ কোথাও গেলেন না; তিনি থাকলেন উত্তরায়ণের প্রান্তর-মধ্যস্থিত পর্ণকুটীরে। পূজাবকাশ বলিয়া অতিথি সমাগত কিছু কম নয়। বাকুড়া হইতে আসেন অধ্যাপক এডোয়ার্ড টমসন, তিনি কবির জীবনী লিখিবার উপকরণ সংগ্রহেরত। মাদ্রাজ হইতে আসিয়াছেন কাজিনস্-দম্পত্তি। তাহারা উঠিয়াছেন কবির পর্ণকুটীরের পাশের কুটীরে। সুকুমার রায় আসেন সপরিবারে— সত্যজিৎ তখন শিশু; সুকুমার তখন অসুস্থ; তাহারা থাকিতেন প্রাক্তন ছাত্রদের বাড়িতে গুরুপল্লীর পথের ধারে। এ ছাড়া আসেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ও তরুণ কবি নজরুল ইসলাম।’
নিশিকান্ত রায় চৌধুরী এক সাক্ষাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গুরুদেবের পাশে দু’জন আগন্তুক সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, তাদের একজনকে আঙ্গুলি-নির্দেশে দেখিয়ে দিয়ে দাদা সুধাকান্ত আমাকে বললেন— ঐ দেখ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই কথা বলে দাদা গিয়ে নজরুলের সান্নিধ্যেই বসলেন। নজরুলের পাশেই ফেজ-পরা, কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে একজন বসে আছেন; তিনি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি কবি গুরুকে বলছিলেন, ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলির সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবি গুরু বললেন, তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার গীতাঞ্জলির গান সবতো আমারই মনে থাকে না। কাজী সাহেব বললেন, গুরুদেব, আমি আপনার কণ্ঠে আপনার একটি গান ও একটি কবিতা শুনতে চাই। শুনে কবি গুরু বললেন, সে কি? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্য প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও, আমাকে আবার রাত্রিবেলার লেখায় ব্যাপৃত হতে হবে। নজরুল দ্বিরুক্তি না করে আবৃত্তি শুরু করলেন আগমনী কবিতাটি (একি রণ-বাজনা বাজে ঘন ঘন)। আবৃত্তির পর কবি গুরু তাকে গান গাইবার আহ্বান জানালেন। এবার তার কণ্ঠে করুণ সুর বেজে উঠল— ‘কোন সুদূরের চেনা বাঁশি ডাক শুনেছিস ওরে চোখা।’
গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনের ডাক আসলে নির্ভিক কবি নজরুল তাতে যোগ দেন। এ সময় তিনি ধূমকেতু নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধু নৃপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নজরুল বললেন, ‘ধূমকেতু নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করছি, আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি মহাকালের তৃতীয় নয়ন, আপনি ত্রিশূল! আসুন, দেশের ঘুম ভাঙাই, ভয় ভাঙাই।’ নৃপেন উৎসাহে ফুটতে লাগলেন। বললেন, ‘এমন শুভকাজে গুরুদেবের কাছে আশির্বাদ ভিক্ষা চাইবেন না?’ নজরুল তাঁকে (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) টেলিগ্রাম করলেন। শুধু নামে আর টেলিগ্রামেই তিনি বুঝতে পারলেন ধূমকেতুর মর্মকথা কী? যৌবনকে চিরজীবী আখ্যা দিয়ে বলাকায় তিনি আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচাতে বলেছিলেন, সেটাতে রাজনীতি ছিল না। কিন্তু এবার নজরুলের ধূমকেতুর জন্য যা লিখে পাঠালেন, তা রীতিমতো রাজনীতি, প্রত্যক্ষ গণজাগরণের সংকেত। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আয়রে আয় চলে ধূমকেত/ আঁধারে বাঁধ তোর অগ্নি সেতু/ দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন’।
রবীন্দ্রনাথের এই আশিসবাণী কবিতাটি ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যায় মূদ্রণের জন্য কবির হস্তাক্ষর ব্লক করানো হয়। প্রথম পৃষ্ঠায়ই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। তার ঠিক উপরেই রবীন্দ্রনাথের হাতের লেখা কবিতাটি প্রতি সংখ্যায় ছাপানো হত। ধূমকেতুতে নজরুলের যে কবিতাগুলো ছাপা হয়, সরকার তা রাজদ্রোহী বলে মনে করে এবং তার ফলে নজরুলের জেল হয়। ১৯২৩ সালে জানুয়ারি মাসে কলকতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট তাকে এক বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
নজরুল প্রেসিডেন্সি জেলে (আলিপুর জেল) থাকা অবস্থায় রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত নামের গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লেখেন, ‘শ্রীমান কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কল্যাণীয়েষু।’ রবীন্দ্রনাথ এই প্রথম অত্যন্ত আপনজনদের বাইরে একজন অপরিচিতকে বই উৎসর্গ করলেন, যে ব্যক্তির তখন বয়স মাত্র ২৪ এবং সেই তরুণকে সম্বোধন করলেন কবি বলে। শুভাকাঙ্ক্ষীদের কেউ কেউ আপত্তি করেছিলেন। তাদের একটা মন্তব্য ছিল এই রকমের যে, ‘নজরুল জনপ্রিয় হয়েছেন চতুর্দিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে বলে, সেটা কমে গেলে তার জনপ্রিয়তা মিইয়ে যাবে।’ উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘জনপ্রিয়তা কাব্যবিচারের স্থায়ী নিরিখ নয়, কিন্তু যুগের মনকে যা প্রতিফলিত করে তা শুধু কাব্য নয়, মহাকাব্য।’
পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন সাহিত্যিকদের ‘খেয়ামাঝি’। তিনি প্রত্যেককেই নিজ নিজ ঘাটে পৌঁছে দিতেন। প্রেসিডেন্সি জেলে গিয়ে নাটকটি নজরুলের হাতে দিয়ে উৎসর্গ পৃষ্ঠা খুলে বললেন, ‘এই দেখ, তোর জন্য কবি কণ্ঠের মালা এনেছি।’ নজরুল বইটি তুলে নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বুকে চেপে ধরলেন। পরবর্তীকালে নজরুল লেখেন, ‘গুরুদেবের এই আর্শীবাদী মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে যাই। কয়েক বছর পর নজরুল যখন ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা বের করেন তখনো রবীন্দ্রনাথ প্রচ্ছদপটের জন্য লিখে দেন, ‘ধর হাল বলরাম আন তব মরু-ভাঙা হল/বল দাও ফল দাও স্তব্ধ হোক ব্যর্থ কোলাহল।’
আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে নজরুলকে হুগলি জেলে আনা হয়। জেলের বৈষম্যমূলক আচরণ ও উৎপীড়ন-নিপীড়নের প্রতিবাদে নজরুল অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বন্ধুবান্ধব নজরুলকে অনশন থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলঙে অবস্থান করছিলেন। নজরুলের বন্ধুরা শিলঙে চিঠি পাঠালেন গুরুদেব যেন নজরুলকে অনুরোধ করেন অনশন ভাঙার। জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘আদর্শবাদীকে আদর্শ ত্যাগ করতে বলা, তাকে হত্যা করারই সামিল। অনশনে যদি কাজীর মৃত্যুও ঘটে তাহলেও তার অন্তরের সত্য ও আদর্শ চিরদিন মহিমাময় হয়ে থাকবে।’ চিঠিতে এ কথা লেখার পর উদ্বিগ্ন রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে টেলিগ্রাম করলেন, ‘এরাব ঁঢ় ুড়ঁৎ যঁহমবৎ ংঃৎরশব, ঙঁৎ ষরঃবৎধঃঁৎব পষধরসং ুড়ঁ’ এই চিঠি ও টেলিগ্রাম থেকে বোঝা যায় নজরুলের আদর্শের প্রতি কতটা শ্রদ্ধাশীল এবং ব্যক্তি নজরুলের প্রতি কতটা স্নেহশীল ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯২২ সালের ২৫ জুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যুতে কলকাতায় রামমোহন লাইব্রেরি হলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে স্মরণসভা হয়। সেখানেও নজরুলকে পাশে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এদিন সভায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ লিখেছেন, ‘বিশ্বকবি মঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং প্রায় পিছু পিছু কবি নজরুলও একেবারে মঞ্চের উপর। কবি গুরুর ইঙ্গিতে তাঁর পাশের আসনেই বসলেন। নিচে সেই গুনগুনানি। তাদের হিসাব মতে, কবি গুরুর পাশে বসবার যোগ্যতা নজরুলের নেই। অথচ ঘটনাচক্রে তিনি রবীন্দ্রনাথের পাশে বসবার সুযোগ পাচ্ছেন বড় বড় সভায়। কি দুর্দৈব!’
মন চাইলেই নজরুল চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য গুরুদেবের সাক্ষাৎ। মাঝে মাঝে পাগলামীও করতেন খুব বেশি। রবীন্দ্রনাথের স্নেহাধিক্যে অদ্ভূত সব কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ফেলতেন নজরুল। একদিনের ঘটনা সম্পর্কে নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে নজরুল বলেন, ‘একবার শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলাম এবং ছিলুমও দিন কয়েক। একদিন দুপুরের পরে কবি বসেছিলেন একা দেহলীর বারান্দায়। বেতের একখানা পিঠ উঁচু চেয়ারে। পায়ের কাছে বসে ওঁর একখানা পা টেনে নিয়েছিলাম কোলের উপর। ইচ্ছে ছিল, একটু টিপে দেব। তারস্বরে কবি চেঁচিয়ে উঠলেন, ওরে, ছাড় ছাড় হাড়গোড় আমার ভেঙে গেল। অপ্রস্তুতের একশেষ। আমি সরে বসেছিলুম। আমার দিকে ফিরে চেয়েছিলেন কবি। চোখ তাঁর পিটপিট করছিল। মুখে মৃদৃ হাসি। বলেছিলেন, ক’খানা গান লিখলে আজ? নাকি খালি চ্যাঁচালেই? মুখ ভাড় করে, মাথা নিচু করে আমি বলেছিলুম, মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানেন?—কী? একটা লাঠির বাড়ি মাথায় মেরে আপনাকে শেষ করে দি?— কেন?—কেন? তাহলে আপনার পাশাপাশি চিরকাল লোকে আমার নাম করবে। আর আমার ছবিও আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে।– কী সর্বনাশ! ওরে কে আছিস, শিগগিরিই আয়। এ পাগলের অসাধ্য কিছু নেই। কবির কণ্ঠ একটু উঁচুই হয়েছিল, কয়েকজন এসেও পড়েছিল। তাদেরকে সবিস্তারে কবি আমার কথার ফিরিস্তিও শুনিয়ে দিলন।’
ছাত্র/ছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য নজরুলকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কোলাহল, হৈ চৈ, করতালিপ্রিয় নজরুল কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনের উদার, শান্ত তপোবনে থাকতে রাজি হননি। তবে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া না দিলেও তাঁর প্রতি নজরুলের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। আমৃত্যু এই শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল।
মাঝেমধ্যে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মধ্যে সাহিত্য বিষয়ে বাদ-প্রতিবাদ, ঝগড়া-বিবাদ যে হয়নি, তা নয়। জেলের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে নজরুল নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ কোনো দিনও কবির কাঙ্গাল নয়, ছিলেন বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস- রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কেউ নন।’ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নজরুলের এ ধারণা সারাজীবন অটুট ছিল। এ ধরনের উক্তি নজরুল তার গুরুদেব সম্পর্কে অনেক করেছেন। কাজী মোতাহার হোসেনকে ১৯২৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নজরুল লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’ বস্তুতপক্ষে এই দুই ইংরেজ কবির মতো নজরুলের পরিণতি ও বিষাদময় পরিণামের কথা ভেবে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
নজরুল এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যে চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা চিঠি ভরে থাকত বিনয়, দাবি আর শ্রদ্ধার সামগ্রীতে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের চিঠিও ভরে উঠত নানা উপদেশ, নির্দেশ আর অপার স্নেহে।
‘নাগরিক’ পত্রিকার পূজা সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লেখেন নজরুল, ‘শ্রীচরণারবিন্দেষু গুরুদেব, বহুদিন শ্রীচরণ দর্শন করিনি। আমার উপর হয়ত প্রসন্ন কাব্যলক্ষ্মী হিজ মাস্টার্স কুকুরের ভয়ে ত্যাগ করেছেন বহুদিন। কাজেই সাহিত্যের আকাশ থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়েছি। আপনার তপস্যায় আমি কখনো উৎপাত করেছি বলে মনে পড়ে না, তাই অবকাশ সত্ত্বেও আমি আপনার দূরে দূরে থেকেছি। তবু জানি আমার শ্রদ্ধার শতদল আপনার চরণ স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি।’
আমার কয়েকজন অন্তরঙ্গ সাহিত্যিক ও কবি বন্ধু ‘নাগরিক’ পরিচালনা করছেন। গতবার পূজায় আপনার কিরণ-স্পর্শে নাগরিক আলোকিত হয়ে উঠেছিল, এবারও আমরা সেই সাহসে আপনার দ্বারস্থ হচ্ছি। আপনার যে কোনো লেখা পেলেই ধন্য হব। ভাদ্রের শেষেই পূজা সংখ্যা নাগরিক প্রকাশিত হবে, তার আগেই লেখনী-প্রসাদ আমরা পাব, আশা করি। আপনার স্বাস্থ্যের কথা আর জিজ্ঞেস করলাম না। ইতি প্রণত নজরুল ইসলাম।
চিঠির জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, কল্যাণীয়েষু, অনেক দিন পর তোমার সাড়া পেয়ে মন খুব খুশি হলো। কিছু দাবি করেছ, তোমার দাবি অস্বীকার করা আমার পক্ষে কঠিন। আমার মুশকিল এই, পঁচাত্তরে পড়তে তোমার অনেক দেরি আছে, সেই জন্য আমার শীর্ণ শক্তি ও জীর্ণদেহেরে পরে তোমার দরদ নেই। তোমাদের বয়সে লেখা সম্বন্ধে প্রায় দাতাকর্ণ ছিলুম, ছোটবড় সকলকে অন্তত মুষ্টিভিক্ষা দিয়েছি। কলম এখন কৃপণ, স্বভাবদোষে নয়, অভাববশত। তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে। অকিঞ্চনের কাছে প্রার্থনা করে তাকে লজ্জা দিও না। এই নতুন যুগে যেসব যাত্রী সাহিত্যতীর্থে যাত্রা করবে, পাথেয় তাদের নিজের ভিতর থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। শুনেছি, বর্ধমান অঞ্চলে তোমার জন্ম। আমরা থাকি তার পাশের জিলায়। কখনো যদি ঐ সীমানা পেরিয়ে আমাদের দিকে আসতে পার খুশি হব। স্বচোক্ষে আমার অবস্থাটাও দেখে যেতে পারবে। ইতি স্নেহরত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ লেখা না পাঠালেও জবাবে যে চিঠি দিয়েছিলেন, তার পরতে পরতে নজরুলের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। এ চিঠির উত্তরস্বরূপ নজরুল তীর্থপথিক নামক কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। কবিতার শেষ লাইন দু’টি এই— ‘প্রার্থনা মোর যদি আরবার জন্মী এ ধরণীতে/ আসি যেন শুধু গাহন করতে তোমার কাব্যগীতে।’
গানের রিহার্সাল রুমে কোনো এক পত্রিকার সম্পাদক নজরুলের কাছে এসেছিলেন কবিতা নেওয়ার জন্য। তিনি রবীন্দ্র সংগীত অপেক্ষা নজরুলের গানের অধিকতর প্রসংশা করলেন। নজরুল তখন ক্ষেপে গেলেন, ধমক দিয়ে বললেন, ‘আমরা যদি কেউ না জন্মাতাম, তাতে কোনো ক্ষতি হতো না, রবীন্দ্রনাথের গান বেদমন্ত্র, তাঁর গান ও কবিতা আমাদের সাত রাজার ধন মানিক। লেখা নিতে এসেছেন, নিয়ে যান, লেখা নিতে এসে এ রকম আমড়াগাছি যেন আর না শুনি।’
রবীন্দ্রনাথে গোরা উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়নের সময় নরেশ্চন্দ্র মিত্র সংগীত পরিচালকরূপে নজরুলকে মনোনীত করেন, তখন সুরকার হিসেবে নজরুলের জনপ্রিয়তা সবার উপরে। চলচ্চিত্রটি যখন মুক্তি পেতে যাচ্ছে, তখন বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ড থেকে আপত্তি ওঠে যে, বোর্ডের অনুমতি না নিয়ে ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করা হয়েছে এবং সুরও যথাযথ নয়; অতএব ছবিটি মুক্তি লাভ করতে পারে না। প্রযোজকের মাথায় হাত! নজরুল কালক্ষেপণ না করে ফিল্মের প্রিন্ট ও প্রজেক্টার নিয়ে ট্যাক্সি করে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্রনাথের কাছে চলে গেলেন। সব শুনে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কী কাণ্ড বলো তো? তুমি শিখিয়েছ আমার গান, আর ওরা কোন আক্কেলে তোমার দোষ ধরে? তোমার চেয়েও আমার গান কি তারা বেশি বুঝবে? আমার গানের মর্যাদা কি ওরা বেশি দিতে পারবে? এ কথা বলে আগেই লিখে রাখা অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর ও তারিখ দিয়ে দিলেন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের স্নেহ থেকে কোনো দিন বঞ্চিত হননি।
নজরুল-রবীন্দ্রনাথের এই চিরায়ত মধুর সম্পর্ক সম্পর্কে বিন্দু-বিস্বর্গ না জেনেই অর্ধশিক্ষিত বাঙালি সমাজ নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা চালায়, তাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করে, উভয়কে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার নিক্তিতে মেপে দ্বিখণ্ডিত করে। কখনো বা সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভাজনে তাদের দু’জনকে শত্রু বানিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু নজরুল-রবীন্দ্রনাথকে যারা সত্যিকার অর্থেই জেনেছে, বুঝেছেন, ধারণ করতে পেরেছেন, তারা স্বীকার করবেন প্রকৃত অর্থেই তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ। নজরুলের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ছিল অপরিমেয়, অপরিসীম। রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের ছিল অতল শ্রদ্ধা। তাদের মধ্যে শত্রুতা তো দূরে থাকুক, মনোমালিন্যও কোনো দিন হয়নি। দানবীয় প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ নিজের সারা জীবনের সুপ্ত শক্তির সাকাররূপ নজরুলের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি নজরুলকে বুকে টেনে নিয়েছেন, পাশে বসিয়েছেন, স্নেহ-শাসনে নজরুলের জীবন পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন কানায় কানায়।
অপরদিকে অনেকেই রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে নিজেদের কাব্যপ্রতিভার ঢোল আপনা-আপনি বাজিয়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে উল্কাবাজি ফোটানোর ব্যর্থ চেষ্টায় আত্ম নিয়োগ করলেও নজরুল সেই অপরিণামদর্শী পথ বেছে নেননি। রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ আসনে রেখে তিনি নিজের সৃষ্টিতে ডুবে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চিন্তা তিনি করেননি বরং স্বতন্ত্র একটি ধারা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাংলাসাহিত্যে নিজের আসনটি পাকা করেছেন, রবীন্দ্রনাথের একনিষ্ঠ ভক্ত হয়েও বাংলা সাহিত্যে মৌলিক প্রতিভার কবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
পরিশেষে এটুকু বলা যায়, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা, চিঠিপত্র, গবেষণা, অনুবাদ সাহিত্য, দর্শন, চিত্রকর্ম, সমাজ সংস্কারমূলক কাজ দিয়ে সর্বজনীন থেকে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে নজরুল তাঁর কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধে খুব সচেতনভাবে মানবতাবাদ, সাম্যবাদ, বিপ্লব, নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের মনোবেদনা তুলে ধরে বাঙালি তথা বিশ্বমানবের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সুতরাং কে বড়? কে ছোট?— এ বিবেচনায় যাওয়া মূঢ়তা ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কারও সমকক্ষ নন, প্রতিদ্বন্দ্বীও নন। দুজনই ছিলেন দুজনের শুভাকাঙ্ক্ষী।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক
Leave a Reply