।।আসাদ জামান।।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সন্ন্যাসী ছিলেন না, ছিলেন পুরাদস্তুর সংসারী। সংসার সংলগ্ন থেকেই অন্তরাত্মায় পরমেশ্বরের সন্ধান করেছেন তিনি। পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠকুর এবং পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহেমিয়ান জীবনের প্রভাব যে তার জীবনে পড়েনি, এমনটি নয়। তবে সংসার বিযুক্ত হয়ে ছন্নছাড়া জীবন বেছে নেওয়ার মধ্যে মুক্তির সন্ধান করেননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এ ব্যাপারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন এভাবে— ‘‘বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়/অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়/লভিব মুক্তির স্বাদ। এই বসুধার/মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার/তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত/নানাবর্ণগন্ধময়। প্রদীপের মতো/সমস্ত সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়/জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়/ তোমার মন্দির-মাঝে/ ইন্দ্রিয়ের দ্বার/রুদ্ধ করি যোগাসন, সে নহে আমার/যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে/তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে / মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া/প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।’’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল ৭ মে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে, ২৫ বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দ ভোর রাত ২টা ৩০মিনিট থেকে ৩টার মধ্যে কলকাতার জোড়াসাঁকো দ্বারকানাথ ঠাকুর লেনের তাঁর পৈত্রিক বাড়িতে। অন্যদিকে ৭ আগস্ট ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে, ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে দুপুর ১২টার কিছু পরে কলকাতার জোড়াসাকোঁতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ২৫ জুলাই ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতাতে নিয়ে আসা হয়।
দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেঁচে ছিলেন ৮০ বছর ৩ মাস। এরমধ্যে মাত্র ১৯ বছর ছিল তার দাম্পত্য জীবন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৯ ডিসেম্বর জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে ভবতারিণী দেবীর সঙ্গে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর ৭ মাস। ভবতারিণী দেবীর বয়স ছিল ১০ বছর। লক্ষণীয় বিষয় হল- বিয়ে কিন্তু কণের বাড়িতে হয়নি, হয়েছে বরের বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথের বিয়েতে তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মেঝ ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বড় বোন সৌদামিনি দেবী উপস্থিত ছিলেন না। বিয়ের দিনেই তাঁর বড় বোন সৌদামিনি দেবীর বর সারদা প্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়।
ভবতারিণী দেবী ১৮৭৩ সালে খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঠাকুর এস্টেটের কর্মচারী বেনীমাধব রায়চৌধুরীর কন্যা ভবতারিণী দেবীর নাম ঠাকুর পরিবারের কাছে বেশ পুরনো ধাঁচের মনে হয়েছিল। তাই বিয়ের পর তাঁর নাম পালটে রাখা হল ‘মৃণালিনী দেবী’। এই নামকরণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
১৯০২ সালে শান্তিনিকেতনে থাকাকালীন মৃণালিনী দেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু ডাক্তার কিছুতেই তাঁর রোগ ধরতে পারছিলেন না। যদিও তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধারণা তাঁর মায়ের অ্যাপেন্ডিসাইটিস (Appendicitis) হয়েছিল। এমতাবস্থায় তিন মাস রোগ-ভোগের পর ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর মাত্র ২৯ বছর বয়সে মৃণালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। মাত্র ৪১ বছর ৬ মাস বয়সে বিপত্নীক হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেন নি তিনি।
পুত্র কন্যা
মৃণালিনী দেবী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তিন মেয়ে ও দুই ছেলেসহ মোট পাঁচ সন্তানের জনক ও জননী ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরা ক্রমানুসারে— ১. বড় মেয়ে মাধুরীলতা দেবী (বেলা), ২. বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রথী), ৩. মেঝো মেয়ে রেনুকা দেবী (রানী), ছোট মেয়ে মীরা দেবী (অতসী) এবং ছোট ছেলে সমীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সমী)।
মাধুরীলতা দেবী
১৮৮৬ সালের ২৫ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথের প্রথম সন্তান মাধুরীলতার জন্ম হয়। কবি তাকে ‘বেলা’ বলে ডাকতেন। আদর করে কখনও কখনও ‘বেলী’ও বলতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় বিশেষত পত্র সাহিত্যে ‘বেলী’ নামের উল্ল্যেখ দেখা যায়।
মাত্র পনের বছর বয়সে ১৯০১ সালের জুলাই মাসে কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর তৃতীয় পুত্র শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর সঙ্গে বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে বিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অসাধারণ রূপ-যৌবনের অধিকারিণী ছিলেন বেলা। কিন্তু সংসার জীবনে সুখী হতে পারেননি তিনি।
বিয়ের সময় কবিগুরু তার বড় জামাতা শরৎ চক্রবর্তীকে যৌতুক হিসেবে দশ হাজার টাকা নগদ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, জামাতাকে নিজ খরচে লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পড়িয়ে এনেছিলেন। ব্যারিস্টারি পাস করে শরৎ চক্রবর্তী কলকাতা ফিরে এসে শ্বশুর বাড়িতে থেকে হাইকোর্টে প্রাকটিস করতেন। কিন্তু, পারিবারিক একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শরৎ তার স্ত্রী বেলাকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
শ্বশুর রবীন্দ্রনাথকে খুব একটা ভালো চোখে দেখত না শরৎ চক্রবর্তী। সে চাইত না তার শ্বশুর তার বাড়িতে আসুক। ব্যাপারটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পারার পরে গোপনে বেলাকে দেখতে যেতেন। কোনো দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শরতের দেখা হয়ে গেলে শরৎ ইচ্ছা করেই শ্বশুরকে নানাভাবে অপমান করার চেষ্টা করত। অনেক সময় রবীন্দ্রনাথের সামনেই সিগারেট ধরিয়ে জুতাশুদ্ধ পা টেবিলের উপর তুলে দিত শরৎ। রবীন্দ্রনাথ মেয়ের সুখের কথা ভেবে সবকিছু নীরবে সহ্য করতেন। শ্বশুর বাড়িতে বেলাকে অনেক কষ্ট নিয়েই থাকতে হতো। বেলা শ্বশুর বাড়ি নানা কষ্টের মধ্যে থাকতে থাকতে এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অতঃপর মাত্র ৩১ বছর ৬ মাস বয়সে ১৬ মে ১৯১৮ সালে যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্বশুরালয়ে মৃত্যুবরণ করেন বেলা। তার জীবনের ছায়া লক্ষ্য করা যায় ‘হৈমন্তী’ গল্পে। মাধুরীলতা দেবী নিঃসন্তান ছিলেন।
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৮৮ সালে। পিতার বিশেষ আগ্রহে আমেরিকা থেকে কৃষিবিজ্ঞানে উঁচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি এবং দেশে ফিরে শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন।
রথীন্দ্রনাথের মা মৃণালিনী দেবী কলকাতায় ঠাকুর বাড়ির পাশে এক প্রতিবেশীর মেয়েকে খুব পছন্দ করতেন। মেয়েটির নাম ছিল প্রতিমা দেবী। মৃণালিনী দেবীর ইচ্ছা ছিল প্রতিমার সঙ্গে রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেবার। রবীন্দ্রনাথের কানেও বিষয়টি গিয়েছিল। কিন্তু মৃণালিনী দেবীর অকাল মৃত্যু এবং রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমেরিকায় পড়তে যাওয়ায় সেই বিয়ে আর হয়নি।
ইত্যাবসরে প্রতিমা দেবীর অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু অল্প কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিমা বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসে। অতঃপর প্রয়াত স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণের একটা সুযোগ পেয়ে যান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিধবা প্রতিমার বিয়ে দিয়ে দেন তিনি। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে প্রতিমা দেবীর এই বিয়ে ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিয়ে। যদিও রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রতিমা দেবী আলাদা হয়ে যান। রথীন্দ্রনাথ-প্রতিমা দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। নন্দিনী (পুপে) নামের একটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছিলেন তারা।
১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। প্রধান কর্মসচিব হিসেবে টানা ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এর পর ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে ভারত সরকার শিক্ষাব্যবস্থায় যে সংস্কার আনে তাতে রথীন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনের উপাচার্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তবে সরকারের নির্দেশ ও পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া রথীন্দ্রনাথের একার কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর রইল না। ফলে স্বাধীনচেতা রথীন্দ্রনাথ বাবা ও নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে কেবল একজন বেতনভুক কর্মচারীর মতো কাজ করতে চাইলেন না। অতঃপর ১৯৫৩ সালে উপাচার্যের পদ ছেড়ে দিয়ে দেরাদুনে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
এরপর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে রথীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আসেন। পিতার এই জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান উদযাপনের একমাস পরেই ১৯৬১ সালের ১৩ জুন ৭২ বছর ৬ মাস বয়সে দেরাদুনে মৃত্যুবরণ করেন রথীন্দ্রনাথ। অন্যদিকে ৭৬ বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন প্রতিমা দেবী।
রেনুকা দেবী
১৮৯১ সালের ২৩ জানুয়ারি রেনুকা দেবীর জন্ম হয়। রেনুকা দেবীকে আদর করে রানী বলে ডাকতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাধুরীলতা দেবীর বিয়ের এক মাসের মাথায় ১৯০১ সালের আগস্ট মাসে মাত্র ১০ বছর ৬ মাস বয়সে সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য নামক জনৈক ব্রহ্মণ যুবকের সঙ্গে রেনুকা দেবীর বিয়ে দেন কবি। বড় জামাতার মতো মেঝ জামাতাকেও নিজ খরচে ডাক্তারি পড়ার জন্য লন্ডনে পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
১৯০২ সালে কবিপত্নী মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর নয় মাস পরে তার দ্বিতীয় কন্যা রেনুকা দেবীও যক্ষ্মায় মারা যায়। রেনুকা চিকিৎসার জন্য সবরকম চেষ্টা করেছিলেন কবি। বায়ু পরিবর্তনের জন্য রেনুকাকে নিয়ে হিমালয় অঞ্চলে দুর্গম পাহাড়েও অবস্থান করেছেন তিনি। কিন্তু, কবির সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। নিঃসন্তান রেনুকা দেবী ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২ বছরের বিবাহিত জীবনের শেষে মাত্র ১২ বছর সাত মাস বয়সে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বিতীয় কন্যার এই অকাল মৃত্যুতে প্রচণ্ড রকম ভেঙে পড়েন কবি।
মীরা দেবী
মীরা দেবী রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠা কন্যা। ১৮৯৪ সালের ১২ জানুয়ারি জন্মগ্রহন করেন তিনি। তাঁকে অতসী নামেও ডাকা হত। মীরার বয়স যখন ১৩ বছর তখন নগেন্দ্রনাথ নামক একজন ব্রাহ্মযুবক রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে অনুরোধ জানায় যে, তাকে আমেরিকায় যাবার ব্যবস্থা করে দিলে সে মীরাকে বিয়ে করতে রাজী আছে। দেখতে সুপুরুষ-শিক্ষিত-মুক্ত মনের ব্রাহ্মযুবক নগেন্দ্রনাথকে কবির পছন্দ হল। ১৩ বছর ৪ মাস বয়সে ৬ জুন ১৯০৭ নগেন্দ্রনাথের সঙ্গে মীরার বিয়ে দিয়ে দিলেন কবি।
শ্বশুরের খরচে নগেন্দ্রনাথ আমেরিকা গিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে ফিরে এলেন। মীরার গর্ভে নিতীন্দ্রনাথ (নিতু) নামে একটি পুত্র সন্তান ও নন্দিতা (বুড়ি) নামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তবে নগেন্দ্রনাথ ও মীরার দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। নন্দিতার জন্মের পরে নগেন্দ্রনাথ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে তাদের পরিত্যাগ করে চলে যায়। মীরা ও সন্তানরা এরপর কবির কাছেই থাকতে লাগল। মীরা দেবী পঁচাত্তর বছর বয়সে ১৯৬৯ সালে শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন।
এর আগে, ১৯৩২ সালে মীরার ছেলে নীতিন্দ্রনাথ মাত্র ২০ বছর বয়সে যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মীরার মেয়ে নন্দিতার বিয়ে হয় উত্তর ভারতের এক অবাঙালি যুবকের সঙ্গে। নন্দিতা নিঃসন্তান ছিলেন।
শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম ও শেষ সন্তান শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২ ডিসেম্বর ১৮৯৬ সালে। এই কনিষ্ঠ পুত্রের চেহারায় রবীন্দ্রনাথের ছাপ ছিল। বাবার অত্যন্ত প্রিয় ছিল সে। শমীন্দ্রনাথ চিৎকার করে বাবার লেখা কবিতা আবৃত্তি করত। বাবার অনেক কবিতা তার মুখস্থ ছিল। শমীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের নিয়মিত ছাত্র ছিল এবং সে এখানকার সব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত। সরোজচন্দ্র নামে এক সহপাঠীর মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়ে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয় শমীন্দ্রনাথ। ১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বর সেখানেই মারা যায় সে। ঠিক পাঁচ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ১৯০২ সালের ২৩ নভেম্বর শমীন্দ্রনাথের মা মৃণালিনী দেবী মারা যান।
নাতি নাতনি
নিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দিতা ক্রিপালানি এবং নন্দিনী ঠাকুর— মোটামুটি এই তিনজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি নাতনি। এর মধ্যে নন্দিনী ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথে বড় ছেলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীর দত্তক কন্যা।
নিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মীরা দেবীর পুত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একমাত্র দৌহিত্র নিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর ডাকনাম ছিল ‘নিতু’। তিনি ১৯১২ সালে জন্মগ্রহন করেন। রবীন্দ্রনাথের এই দৌহিত্রকে উচ্চ শিক্ষার জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়। সেখানেই তিনিও যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। অতঃপর মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৩২ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। নিতীনদ্রনাথ ঠাকুর অকৃতদার ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ৭১ বছর।
নন্দিতা ক্রিপালানি
মীরা দেবীর কন্যা নন্দিতা ক্রিপালানি (বুড়ি) ১৯১৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক কৃষ্ণ ক্রিপালানির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এই দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। একান্ন বছর বয়সে ১৯৬৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নন্দিনী ঠাকুর
রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর দত্তক কন্যা নন্দিনী ঠাকুর। ১৯২২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩৯ সালের ৩০ জানুয়ারি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এর বেশি কিছু তাঁর সম্পর্কে জানা যায়নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পাবার আগেই মা সরদা দেবী, মাতৃতুল্য বৌদি কাদম্বরী দেবী, স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, দুই কন্যা মাধুরীলতা দেবী ও রেনুকা দেবী এবং পুত্র শমীন্দ্রনাথকে হারিয়েছিলেন। এদের কেউই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যায়নি। সবারই অকাল মৃত্যু হয়েছে। শুধু মাতা, বৌদি, পত্নী, পুত্র, কন্যা নয়, জীবদ্দশায় দৌহিত্রেরও মৃত্যু দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একের পর এক মৃত্যু তার সংসারকে তছনছ করে দিয়েছে। তিনি দুঃখের সাগরে পতিত হয়েছেন। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, স্নেহের ধন, বন্ধু-বান্ধব হারানোর যন্ত্রণা বুকে ধারণ করে পরমাত্মার সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। রচনা করেছেন বিশ্বমানবের জয়গান। জীবন ও জগতের অমোঘ সত্য উচ্চারণ করেছেন নানা সাহিত্যকর্মে।
লেখক: সাংবাদিক ও রবীন্দ্র গবেষক
Leave a Reply