রবীন্দ্রকাব্যে ঘোর না কাটা প্রেম

রবীন্দ্রকাব্যে ঘোর না কাটা প্রেম

।। আসাদ জামান ।।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে এবং পরে লালন শাহ, হাছন রাজা, রাধারমন, বিজয় সরকার, জসীম উদদীন, শাহ আব্দুল করীমের মতো মরমী কবি ও সাধকেরা এসেছেন এ বাংলায়। তারা গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত সাধারণ জনগোষ্ঠীর চিত্তে দারুণ এক নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ বাঙালি সমাজকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেন তারা, ভীষণভাবে দোলা দেন। কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাজগতে ঘোর লাগা আলোড়ন সৃষ্টির কাজটি করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ঘোর এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি!

বৈষ্ণব পদাবলীর পর বাঙালি তার বিচিত্র প্রেমের সন্ধান পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, ষোড়শ শতাব্দীতে বৈষ্ণব পদাবলীর মাধ্যমে বাঙালি যে প্রেমের সন্ধান পেয়েছিল তার উৎসস্থল ছিল স্বদেশ। আর রবীন্দ্রনাথের কলমের ডগা এবং মনের সংযোগে বাংলা কবিতায় প্রেমের যে জগৎ গড়ে উঠল, তার উৎসস্থল ছিল ইউরোপ। ফলে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি শ্রী চৈতন্যদেবের পৌরোহিত্যের ফসল বৈষ্ণব পদাবলীর প্রেম থেকে উঠে এসে ইউরোপাগত প্রেমরসে ডুব দিল।

এই নতুন প্রেমের উচ্ছ্বাস এতটাই প্রবল ছিল যে, বাঙালির রোমান্টিক দাম্পত্য জীবনের অন্দরমহলে তা ঢুকে পড়ে। এর প্রমাণ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্ত্রীদের লেখা চিঠিতে পাওয়া যাবে বলে নীরদচন্দ্র চৌধুরী তার ‘আত্মঘাতী বাঙালি’বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তার ভাষ্যমতে, স্ত্রীদের লেখা চিঠিতে প্রেমের এতো আতিশয্য থাকত যে, সেগুলো প্রাপকের কাছে পৌঁছানোর আগেই পিয়নরা পড়ে ফেলত। কখনো কখনো পিয়নকে টাকা দিয়ে যুবকরা সেগুলো পড়ত।

এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, রবীন্দ্রনাথের প্রেমে রূপ-রস, গন্ধ, স্পর্শ কেমন ছিল? যা দিয়ে তিনি প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে শিক্ষিত ‘আধুনিক’ বাঙালি সমাজকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন? নিজের প্রেমানুভূতিকে প্রকাশ করার জন্য শিক্ষিত বাঙালি বারবার তার কাছেই ফিরে যায়?

এ প্রশ্নের জবাবে অনায়াসে বলা যায়, কাব্যে এবং শিল্পে প্রেমকে জীবন্ত করে তোলার জন্য কবি এবং শিল্পীকে যতটা রোমান্টিক হতে হয়, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ততটাই রোমান্টিক। রোমান্টিকদের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকে, তার সবই রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল। তীব্র কল্পনাপ্রবণতা, সুদূরের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সূক্ষ্ম সৌন্দর্যবোধ, প্রকৃতির প্রতি বাঁধভাঙা আকর্ষণ রবীন্দ্র প্রতিভার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য রবীন্দ্রনাথের প্রেমানুভূতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে প্রেমানুভূতির জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে নারীর প্রত্যক্ষ শারীরিক উপস্থিতির প্রয়োজন হয়নি। বরং নারীর শারীরিক উপস্থিতিকে তিনি প্রেমের অন্তরায় বলে মনে করতেন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, কাঙ্ক্ষিত নারী যখন কল্পনা থেকে বাস্তবের মধ্যে চলে আসে, কল্পনার অসীম থেকে সংসারের সীমার মধ্যে চলে আসে, তখন প্রেম আর থাকে না। কারণ ‘অনন্ত আকাশের ফাঁক না পেলে বাঁশি বাজে না’। এ কারণে সংসার-সীমার বাইরে কল্পনার জগতে থাকা নারী যখন সংসারের মধ্যে এসেছে তখন রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কেন মূর্তি হয়ে এলে/ রহিলে না ধ্যান ধারণার/কেন হায় ঝাঁপ দিতে শুকালো পাথার?’

উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তার রবীন্দ্রকাব্য-পরিক্রমা গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে প্রেম দেহের চারিপাশে ঘুরিয়া মরে, ব্যক্তি-মানুষের বাস্তব দেহ মন যাহার ভিত্তি, সেই আবেগময়, আত্মহারা, সাধারণ মানুষের প্রেম রবীন্দ্রনাথের প্রেম নয়। প্রেম অসীম, অনন্তের ধন, আত্মার সম্পদ, দেহের সীমায় তাহাকে ধরা যায় না। কবির ভাষায়, ‘ভালোবাসো, প্রেমে হও বলী/ চেয়ো না তাহারে (‘নিস্ফল কামনা’, মানসী)।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমের প্রশ্নে ছিলেন আদ্যোপান্ত ‘বিশুদ্ধবাদী’। প্রেমের ক্ষেত্রে শরীরকে তিনি বরাবরই গৌণ মনে করতেন। বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায় তার ‘সুরদাসের প্রার্থনা’ কবিতায়। ওই কবিতায় কবি তার প্রেয়সীকে দেবী সম্বোধন করে বলেছেন, ‘এ আঁখি আমার শরীরে তো নাই, ফুটেছে মর্মতলে—/ নির্বাণহীন অঙ্গারসম নিশিদিন শুধু জ্বলে।/ সেথা হতে তারে উপাড়িয়া লও জ্বালাময় দুটো চোখ— / তোমার লাগিয়া তিয়াস যাহারা সে আঁখি তোমারি হোক।।’ অন্ধ হয়ে গেলে অর্ন্তচক্ষু দিয়ে কবি প্রেয়সীকে দেখবেন— এটাই কবির আরাধ্য। মধ্যযুগের বাংলা কবিতার শারীরিক প্রেমের পরিবর্তে এই প্রেম নতুন দ্যোতনা তৈরি করে। প্রেমের এই ধারণা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ সানন্দে গ্রহণ করেছিল।

রবীন্দ্রনাথ ও কালিদাসের কবিপ্রতিভা ও জীবনচেতনার তুলনা করতে গিয়ে কাজী আবদুল ওদুদ তার ‘শাশ্বত বঙ্গ’ বইয়ের ‘কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘কালিদাস যথেষ্ট ভোগবাদী, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাদী; কালিদাসের সৌন্দর্য-বোধ ও রসবোধের চাইতে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যবোধ ও রসবোধ সূক্ষ্ণতর।’

কল্পনা কাব্যের ‘স্বপ্ন’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তার ‘পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়া’র সঙ্গে দেখা করেছেন। পরস্পর পরস্পরের কাছে এসেছেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ যে বর্ণনা দিলেন, তা তার প্রেমের ধারণাকে স্পষ্ট করে তুলেছে, ‘মোরে হেরি প্রিয়া/ ধীরে ধীরে দীপখানি দ্বারে নামাইয়া/ আইল সম্মুখে, মোর হস্তে হস্ত রাখি/ নীরবে শুধালো শুধু, সকরুণ আঁখি,/ “হে বন্ধু, আছ তো ভালো?” মুখে তার চাহি/ কথা বলিবারে গেনু কথা আর নাহি।/

রবীন্দ্র প্রেমের এই শালীন, শৈল্পিক আর সূক্ষ্ম রূপই ইউরোপীয় শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সেদিন উন্মাতাল করেছিল; আবিষ্ট করেছিল। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে এই শ্রেণি প্রেম সম্পর্কে যে ধারণা আর রুচি অর্জন করেছে, সেই ধারণা আর রুচিরই প্রতিফলন তারা দেখতে পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতার মধ্যে।

রবীন্দ্রনাথের মতো প্রেমিক পুরুষ বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই— দেড় শতাব্দী পর এসে নতুন করে এ কথাটি বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তার মতো কামগন্ধহীন সূক্ষ্ম প্রেমের প্রকাশ আর কোনো কবির মধ্যে দেখা যায় না। তার প্রেমানুভূতির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, এর সঙ্গে কবি গভীরভাবে লিপ্ত থাকেন। এ কারণে রবীন্দ্রনাথের মানবপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেম, নারীপ্রেম সমান আবেগ আর আন্তরিকতায় রূপায়িত। রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি প্রেমের যে কোনো কবিতাকে বা ঈশ্বরপ্রেমের যে কোনো কবিতাকে শিক্ষিত বাঙালি প্রেমিক তার প্রেমিকার উদ্দেশে নিবেদন করতে পারে। যুগে যুগে করেছেও তাই। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রে এ ঘটনা বোধ করি সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি/ তোমায় দেখতে আমি পাই নি/ বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি।। তখন মনে হয় এ বুঝি প্রেমিকার উদ্দেশে প্রেমিকের কথা। কিন্তু এটা আদৌ নারীপ্রেমের কবিতা নয়। এভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা যুগ যুগ ধরে শিক্ষিত বাঙালি প্রেমিক হৃদয়ের অব্যক্ত কথাকে ব্যক্ত করে চলেছে।

লেখক: সাংবাদিক, রবীন্দ্র গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *