|| আসাদ জামান ||
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সাহিত্যানুরাগীদের যে জিজ্ঞাসা, তার মূলে রয়েছে প্রেম! সে প্রেম তার ব্যক্তিজীবনে এবং কাব্যভুবনে সমানভাবে ব্যাপ্ত! সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে প্রেমরস আস্বাদনের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গান, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনীর যেমন জুড়ি মেলা ভার, তেমনি তার ব্যক্তি জীবনের ‘প্রেম’ রসিকজনের কাছে রসের আধার! বলতে গেলে রবীন্দ্রনাথের জীবনে প্রেম এসেছিল শ্রাবণের ধারার মতো। আবার জীবন থেকে সে প্রেম ঝরে পড়েছে শ্রাবণের ধারার মতোই। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে, ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে একের পর এক রমণীর প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। আবার প্রেমকাতর রমণীদের কাছ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ সরিয়ে নিয়ে পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত হওয়ার আরাধনার মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন সম্পূর্ণ ‘রবীন্দ্রনাথ’।
সতের বছর বয়স থেকে শুরু করে তেষট্টি বছর বয়স পর্যন্ত অসংখ্য রমণীর প্রেমে পড়েছেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে তার প্রণয়িনীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। এদের মধ্যে অনেকের নাম রবীন্দ্রনাথের জীবনের সাথে সমান্তরালভাবে উচ্চারিত হয়েছে। অনেকের নাম কালের কপলতলে হারিয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের কয়েকজন প্রণয়িনীকে এ লেখায় হাজির করতে চাই।
আন্না তরখড়
রবীন্দ্রনাথ ১৮৭৮ সালের আগস্টে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কর্মস্থল বোম্বাইতে তার বন্ধু ডা. আত্মারাম পান্ডুরংয়ের পরিবারে আশ্রয় গ্রহণ করেন স্পোকেন ইংলিশে ও ইংরেজদের আদবকায়দা শেখার উদ্দেশ্যে। কোলকাতার ব্রাহ্মসমাজের মতো মহারাষ্ট্র-গুজরাটের ‘প্রার্থনা সমাজ’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আত্মারামের পরিবার বোম্বাই অঞ্চলে ধর্ম ও সমাজ-সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। আর তার বিলেতফেরত কন্যা আন্না অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে ইংরেজিয়ানায় প্রশিক্ষিত করে তুলতে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘কবির কাছ থেকে একটা ডাকনাম চাইলেন, দিলেম যুগিয়ে-সেটা ভালো লাগল তার কানে। ইচ্ছে করেছিলেন সেই নামটি আমার কবিতার ছন্দে জড়িয়ে দিতে। বেঁধে দিলুম সেটাকে কাব্যের গাঁথুনিতে; শুনলেন সেটা ভোরবেলাকার ভৈরবী সুরে; বললেন, “কবি, তোমার গান শুনলে আমি বোধ হয় আমার মরণদিনের থেকেও প্রাণ পেয়ে জেগে উঠতে পারি।”
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতে, রবীন্দ্রনাথের দেওয়া আন্নার ডাকনামটি হলো ‘নলিনী’। এটি তার একটি অত্যন্ত প্রিয় নাম, প্রথম জীবনে রচিত বহু কাব্য-কবিতায় ও নাটকে নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। কাব্য-নাটকে ‘নলিনী’ চরিত্রটি প্রায়শই একটি চপল-স্বভাবা আপাত-নিষ্ঠুরা, অথচ প্রেমময়ী নারী।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি অতুলপ্রসাদ সেন ও দিলীপকুমার রায়ের সাথে আলাপে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘তখন আমার বয়স বছর ষোলো। আমাকে ইংরেজি কথা বলা শেখানোর জন্যে পাঠানো হলো বম্বেতে একটি মারাঠি পরিবারে। সে পরিবারের নায়িকা একটি মারাঠি ষোড়শী। যেমন শিক্ষিতা, তেমনি চালাক-চতুর, তেমনি মিশুক। তার স্তাবক-সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না- বিশেষ আরও এই জন্যে যে, ঐ বয়সেই সে একবার বিলেত ঘুরে এসেছিল।’
‘আমার সঙ্গে সে প্রায়ই যেচে মিশতে আসত। কত ছুতো করেই সে ঘুরত আমার আনাচে কানাচে। আমাকে বিমর্ষ দেখলে দিতো সান্ত্বনা, প্রফুল্ল দেখলে পিছন থেকে ধরত চোখ টিপে।’
‘আমি বেশ টের পেতাম যে ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটছে, কিন্তু হায় রে, সে-হওয়াটাকে উস্কে দেওয়ার দিকে আমার না ছিল কোনোরকম তৎপরতা, না কোনো প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। ‘একদিন সন্ধ্যাবেলাৃসে আচম্কা এসে হাজির আমার ঘরে। চাঁদনি রাত। চারদিকে সে যে কী অপরূপ আলো হাওয়া!ৃকিন্তু আমি তখন কেবলই ভাবছি বাড়ির কথা। ভালো লাগছে না কিছুই। মন কেমন করছে বাংলাদেশের জন্যে, আমাদের বাড়ির জন্যে, কলকাতার গঙ্গার জন্যে। হোমসিকেনস যাকে বলে।
সে বলে বসল, “আহা, কী এত ভাবো আকাশপাতাল!” তার ধরন-ধারণ জানা সত্ত্বেও আমার একটু যেন কেমন কেমন লাগল। কারণ সে প্রশ্নটি করতে না করতে একেবারে আমার নেয়ারের খাটির উপরেই এসে বসল। কিন্তু কী করি- যা হোক হুঁ হাঁ করে কাজ সেরে দিই। সে কথাবার্তায় বোধহয় জুৎ পাচ্ছিল না।
‘শেষে একদিন বলল, “জানো কোনো মেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে যদি তার দস্তানা কেউ চুরি করতে পারে তবে তার অধিকার জন্মায় মেয়েটিকে চুমো খাওয়ার?” বলে খানিক বাদে আমার আরাম কেদারায় নেতিয়ে পড়ল নিদ্রাবেশে। ঘুম ভাঙতেই সেই চাইল পাশে তার দস্তানার দিকে। একটিও কেউ চুরি করে নি।’
রসশাস্ত্রের বিচারে আন্নাকে অনেকটা প্রগল্ভা নায়িকার পর্যায়ে ফেলা যেতে পারে, কিন্তু তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাছে না হলেও পরিণত রবীন্দ্রনাথের কাছে সে প্রেম যথেষ্ট গুরুত্ব লাভ করেছে।
উপরোক্ত কথোপকথনের সূত্রেই তিনি বলেছিলেন, ‘কিন্তু সে মেয়েটিকে আমি ভুলিনি বা তার সে আকর্ষণকে কোনো লঘু লেবেল মেরে খাটো করে দেখিনি কোনো দিন। আমার জীবনে তারপরে নানা অভিজ্ঞতার আলোছায়া খেলে গেছে- বিধাতা ঘটিয়েছেন কত যে অঘটন- কিন্তু আমি একটা কথা বলতে পারি গৌরব করে যে, কোনো মেয়ের ভালোবাসাকে আমি কখনো ভুলেও অবজ্ঞার চোখে দেখিনি- তা সে ভালোবাসা যেরকমই হোক না কেন।’
আন্নার প্রেমকে রবীন্দ্রনাথ স্বীকৃতি দিয়েছেন শেষ বয়সে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় অনুমান করেছেন, শৈশবসংগীত কাব্যগ্রন্থের ‘ফুলের ধ্যান’ ও ‘অপ্সরা-প্রেম’ কবিতা দুটিতে এই তরুণীর মর্মবেদনা কবির ভাষায় রূপ পেয়েছে এবং ‘আমি স্বপনে রয়েছি ভোর, সখী, আমারে জাগায়ো না’ গানটির মধ্যে দস্তানা চুরির কৌতুককর কাহিনীর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। মালতীপুঁথি’তে পাওয়া না গেলেও রবিজীবনীকারের ধারণা ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যের চতুর্থ সর্গে কবির অষ্টম গানটি—‘শুনেছি—শুনেছি কি নাম তাহার—/শুনেছি— শুনেছি তাহা!/নলিনী—নলিনী—নলিনী—/ কেমন মধুর আহা!’ ইত্যাদি আন্না-কে লক্ষ্য করেই রচিত।
রবীন্দ্রনাথের গ্যেটে ও তাঁহার প্রণয়িনীগণ প্রবন্ধে এক জায়গায় আছে, ‘এক প্রকার তাস খেলা আছে, হারিলে চুম্বন দিতে হয়- গ্যেটে এই চুম্বনের পরিবর্তে কবিতা উপহার দিতেন—কিন্তু যে মহিলার তাঁহার নিকট হইতে চুম্বন প্রাপ্য থাকিত তাঁহার যে মর্ম্মে আঘাত লাগিত তাহা বলা বাহুল্য।’ এই বর্ণনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কোনো যোগ আছে কি না সেটা রসজ্ঞ পাঠকদের অনুমেয়- বলেছেন রবিজীবনীকার।
১৮৭৯ সালের ১১ নভেম্বর বরোদা কলেজের উপাধ্যক্ষ হ্যারন্ড লিট্লেডলের সঙ্গে আন্নার বিয়ে হয়। আন্নার মৃত্যু হয় ১৮৯১ সালের ৫ জুলাই এডিনবরা শহরে।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বিবাহিত জীবনেও আন্না রবীন্দ্রনাথকে ভোলেননি। সেই কিশোর-কবির প্রদত্ত আদরের ডাক নাম ‘নলিনী’ স্বাক্ষরেই তিনি প্রবন্ধাদি প্রকাশ করতেন— তার অপেক্ষাকৃত পরিণত মনেও সেই ‘আপন-মানুষের দূত’ গভীর স্বাক্ষর এঁকে দিয়েছিলেন, এ তারই প্রমাণ। এ প্রসঙ্গে এই তথ্যটিও উল্লেখযোগ্য যে, তার এক ভ্রাতুষ্পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’।
কাদম্বরী দেবী
রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর সম্পর্ক নিয়ে অতি সাধারণ পাঠক এবং স্বল্প শিক্ষিতজনের মুখেও নানারকম গল্প হরহামেশা শোনা যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্য প্রণয়িনীদের নিয়ে লেখা যতো সহজ কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে লেখা ততো সহজ নয়। যাই লেখা হোক, সেটা নিজের ধারণার ভূগোল অনুযায়ী না হলে কিছুতেই গ্রহণ করতে চায় না বাঙালি সমাজ। তাই নিরাপদ অবস্থানে থেকে ঐতিহাসিক কিছু ঘটনার সন্নিবেশ করাই ভালো।
কাদম্বরী দেবী (প্রকৃত নাম মাতঙ্গিনী গঙ্গোপাধ্যায়) ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সপ্তম সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। কাদম্বরীর বয়স যখন ৯ বছর, তখন ১৯ বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে তার বিয়ে হয়। কাদম্বরীর পিতা শ্যাম গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বাজার সরকার। সামাজিক প্রতিপত্তিতে কাদম্বরীদের পরিবার ঠাকুর পরিবারের সমকক্ষ না হলেও ঠাকুরবাড়ির কিছু ধর্মঘটিত বাধ্যবাধ্যকতা ও দেবেন্দ্রনাথের নির্বন্ধের কারণে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। কাদম্বরী যখন পুত্রবধূ হিসেবে ঠাকুর পরিবারে প্রবেশ করেন, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ৭। অর্থাৎ কাদম্বরীর চেয়ে ২ বছরের ছোট ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৬ বছর বৈবাহিক জীবনযাপন করার পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আফিম খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কাদম্বরী। তার দুদিন পর ২১ এপ্রিল তার মৃত্যু হয়।
বাঙালি সমাজে একজন বিবাহিতা তরুণীর আত্মহত্যা স্বভাবতই কৌতূহলোদ্দীপক। যদিও সেকালের বাঙালি এই বিষয়ে সম্ভবত খুব একটা কৌতূহল দেখানোর সুযোগ পায়নি। কারণ ঠাকুরবাড়ির উদ্যোগে গোটা বিষয়টিই ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, সমকালে বাঙালি যদি এই বিষয়ে কৌতূহল প্রকাশ না করে থাকে, তাহলে পরবর্তীকালে এই নিয়ে হঠাৎ তার আগ্রহ জেগে উঠল কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে, কাদম্বরী বিষয়ক আলোচনার পথ প্রশস্ত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের লেখালেখির সূত্র ধরে। ৫১ বছর বয়সে ‘জীবনস্মৃতি’ (১৯১২) লিখতে বসে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সাথে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী।’ ১৯৪০ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’ লিখলেন, তখন উন্মোচিত হলো কাদম্বরীর সাথে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের নানা দিক। জানা গেল, কীভাবে ‘‘যা-তা তর্ক নিয়ে কথা-কাটাকাটি’’ চলত দুজনের, কীভাবে ঠাকুরপোর কবিত্বশক্তিকে একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে কাদম্বরী ‘‘কেবলই খোঁটা দিয়ে বলতেন, কোনোকালে বিহারী চক্রবর্তীর মতো’’ লিখতে পারবেন না তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যখন কাছারিতে যেতেন তখন তেতলার ঘরের দ্বিপ্রাহরিক নির্জনতায় বউদি ও দেওরের সময় কাটত পারস্পরিক সান্নিধ্যে।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্ক বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কিছু কম হয়নি। এমতাবস্থায় একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘রবীন্দ্র-কাদম্বরীর সম্পর্ক যে নিশ্চিতভাবে বিশুদ্ধ প্রেম সম্পর্কই ছিল- এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট প্রমাণ কি আমাদের হাতে এসেছে?
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘বিশুদ্ধ প্রেম’ বস্তুটি কী? ‘বিশুদ্ধ প্রেম’ বলতে আমরা বোঝাচ্ছি সেই মনোভাবকে যাকে মনস্তত্ত্ববিদ রবার্ট স্টার্নবার্গ তার ত্রিবিধ প্রণয়তত্ত্বে ‘কনজিউমেট লাভ’ বলে চিহ্নিত করেছেন, যার ত্রয়ী উপাদানের একটি হল ‘প্যাশন’ বা পারস্পরিক যৌনাকাঙ্খা, অন্য দু’টি উপাদান হল ‘ইন্টিমেসি’ ও ‘কমিটমেন্ট। প্রশ্ন হল, রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্কে পারস্পরিক যৌনাকাঙ্খার অস্তিত্ব ছিল কী?
রবীন্দ্র-কাদম্বরী সম্পর্ক নিয়ে কোনো সন্দেহাতীত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পথে অন্যতম প্রধান সীমাবদ্ধতা হলো এই যে, এই সম্পর্ক বিষয়ে কাদম্বরীর ভাষ্যটি কোনোদিনও জানা সম্ভব নয়। তিনি নিজে কিছু লিখে যাননি, অন্তত আমাদের হাতে আসেনি তার কোনো লেখা। তাকে যেটুকু আমরা চিনেছি তা রবীন্দ্রনাথের সূত্রেই চেনা। রবীন্দ্রনাথ তাকে যেভাবে দেখেছিলেন, অনুভব করেছিলেন, সেইভাবেই তুলে ধরেছেন আমাদের সামনে। বলা বাহুল্য, এভাবে জানা পূর্ণাঙ্গ জানা নয়। ফলে কাদম্বরীর নিজের মনোভাব কী ছিল তার এই ঠাকুরপোটির প্রতি, তা কেবল অনুমাননির্ভর একটি বিষয়। কাজেই এই সম্পর্ক-রহস্য ভেদের প্রক্রিয়াটি প্রায় বাধ্যতামূলকভাবেই একমুখী।
রবীন্দ্রনাথই বা কী দৃষ্টিতে দেখতেন কাদম্বরীকে? কোনো কোনো গবেষক স্বতঃসিদ্ধ হিসেবেই ধরে নিয়েছেন যে, রবীন্দ্রচিত্ত কাদম্বরীর প্রতি প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। এরপর রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখা থেকে তাঁরা কাদম্বরী-প্রেমের প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্রজীবনীতে’ রবীন্দ্রনাথের কাব্যাকাশের ধ্রুবতারা বলে কাদম্বরীকে চিহ্নিত করেছিলেন। আর জগদীশ ভট্টাচার্য কাদম্বরীকে কবির প্রণায়াকাশের ধ্রুবতারা বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় রত হলেন তার ‘কবিমানসী’ গ্রন্থে।
জগদীশ ভট্টাচার্য বলেছেন, “আমাদের পারিবারিক জীবনে সমবয়স্ক দেবর ও ভাতৃবধূর যে সম্পর্ক স্বভাবতই অতি মধুর, রবীন্দ্রনাথের জীবনে তা মধুরতম রূপ নিয়েই দেখা দিয়েছিল। বস্তুত, কাদম্বরী দেবীর প্রতি তরুণ রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ানুরাগই তার জীবনের গভীরতম উপলব্ধি এবং কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুই রবীন্দ্রজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছিলেন, “মায়ের মৃত্যুর পরে বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন (অর্থাৎ কাদম্বরী) তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন। তিনিই আমাদিগকে খাওয়াইয়া পরাইয়া সর্বদা কাছে টানিয়া, আমাদের যে কোনো অভাব ঘটিয়াছে তাহা ভুলাইয়া রাখিবার জন্য দিনরাত্রি চেষ্টা করিলেন।’
লক্ষ করার বিষয়, ‘মাতৃহীন বালকদের’ কথাটার উল্লেখের পরেও রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করছেন ‘আমাদিগকে’, যা ওই মাতৃহীন বালকদের মধ্যে তার নিজের অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করছে। একথাও স্মরণযোগ্য যে, কাদম্বরী নিজেও ছিলেন নিঃসন্তান। ফলে ‘মাতৃহারা দেবরকে তিনি প্রায় মাতার স্নেহেই যতœ করেছেন।’
কাদম্বরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ শারীরিক সম্পর্কের লেশমাত্র ছিল না- একথা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। জীবনের একটিমাত্র পর্বে রবীন্দ্রনাথ ‘স্তন’, ‘চুম্বন’, ‘দেহের মিলন’ বা ‘বিবসনা’র মতো কবিতা লিখেছেন এবং সেই পর্ব তার বিয়ের অব্যবহিত পরবর্তী কয়েকটি দিনব্যাপী। বোঝা যায়, অনাস্বাদিতপূর্ব দেহসুখ আস্বাদনের পরে যে আলোড়ন অনুভব করেছিলেন কবি, সেই চাঞ্চল্যই তাকে দিয়ে এই কবিতাগুলো লিখিয়ে নিয়েছিল। তবে দৈহিকতা সম্ভব না হলেই যে প্রেম অসম্ভব হবে, এমনটা নয়। অতএব জানতে ইচ্ছে করে, কাদম্বরীর প্রতি যদি কোনও প্রণয়াবেগ অনুভব করেও থাকেন কবি, কখনও কি প্রণয়সম্ভাষণ করেছিলেন তাকে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অন্য একটি প্রশ্নও জাগে মনে, জীবনে আদৌ নিজের স্ত্রী ব্যতীত কোনও নারীর প্রতি কখনও নিজের প্রণয়ভাব স্পষ্টত ব্যক্ত করেছেন কি রবীন্দ্রনাথ? আন্না তরখড় বা বিলেতে মিসেস স্কটের দুই কন্যা, যারা কবির প্রণয়প্রার্থী ছিল বলে কবি নিজেই জানিয়েছিলেন বয়সকালে, তাদের কি কখনও তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘ভালোবাসি’? এমনকী রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যজগতের কয়টি চরিত্র স্পষ্টত ব্যক্ত করতে পেরেছে কোনো নারী বা পুরুষের প্রতি নিজেদের প্রণয়াবেগের কথা? আসলে, রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসার ক্ষেত্রে এক আলোআঁধারি সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন বলে মনে হয়। এমন এক ভালবাসায় তার আস্থা ছিল যা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিচয়ে বন্দি নয়, সুনির্দিষ্ট অবয়বহীন এবং সেই কারণেই যেকোনো অবয়ব ধারণে যার বাধা নেই। ফলে কাদম্বরীকে যদি কোনো দিন ভালোবেসেও থাকেন রবীন্দ্রনাথ, সে কথা তার কাছে স্পষ্টত ব্যক্ত করা তার স্বভাববিরুদ্ধ ছিল বলেই মনে হয়।
রানু মুখার্জি
প্রেমের গতি বিচিত্র। প্রেম বয়স, জাত-পাত, স্থান, কাল, পাত্র, ধর্ম কিছু মানে না। দুটি হৃদয় কোনো কিছু বিচার না করে কখন একে অন্যের নিকটে এসে যায়, আমরা তা বুঝতে পারিনা। যখন বুঝতে পারি, তখন দুজনের মধ্যে একটা ভালোলাগা বা প্রীতির সম্পর্ক জন্ম নেয় এবং এই সম্পর্ক প্রেমে পরিণত হয়।
হৃদয়বান পুরুষদের বয়স যাই হোক না কেন, হৃদয়ে প্রেম জাগতে বাধা নেই। প্রেমিকার বয়স কোনোদিন পুরুষের প্রেম নিবেদনে বাধা হয়নি। পঞ্চশোর্ধ পুরুষ নিজের কন্যার সমবয়সী নারীর সাথে এমনকি নাতনীর বয়সী কিশোরীর সাথেও প্রেমের জালে জড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছেন, ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে/ কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে’ – রবীন্দ্রনাথ তার নিজের জ়ীবনের উপলব্ধি থেকেই হয়তো একথা লিখেছেন। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ও কিশোরী রাণুর প্রেম একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
অসমবয়সী রানু ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এক আশ্চর্য অন্তরঙ্গ নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯১৭ থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত। শিল্পপতির পুত্র বীরেন্দ্রের সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়ে গেলে রানু-রবীন্দ্রের দীর্ঘ আট বছরের প্রীতি-ভালোবাসার মধুর পরিণত সম্পর্কটি ছিন্ন হয়ে যায়। এই সময় সুন্দরী রানুর বয়স উনিশ। ১৯১৭ সালে পরস্পরের পত্রবিনিময়ের মাধ্যমে যখন দুজনের অনির্বচনীয় একটি সম্পর্কের ভিত্তিভূমি রচিত হচ্ছিল তখন রানুর বয়স এগারো, আর সেই সময় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের বয়স ছাপ্পান্ন। চিঠির পর চিঠিতে ‘ভারী দুষ্টু’ রবীন্দ্রনাথকে চুম্বনের পর চুম্বন দিতে দিতে ‘প্রিয় রবিবাবু’কে রানু বলে, ‘কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলবেন আপনার বয়স ‘সাতাশ’।” উত্তরে রবীন্দ্রনাথ কৌতুক করে বলেন, ‘আমার ভয় হয় পাছে লোকে সাতাশ শুনতে সাতাশি শুনে বসে। তুমি যদি রাজি থাক তাহলে আমি আর একটা বছর কমিয়ে বলতে পারি। কেন না ছাব্বিশ বললে ওর থেকে আর ভুল করবার ভাবনা থাকবে না।’
পঞ্জিকার হিসাবে রবীনদ্রনাথ ঠাকুরের বয়স পঞ্চান্ন ষাট বাষট্টি যাই হোক দেহসৌষ্ঠবে ও গঠনে তিনি ছিলেন অতুলনীয় রূপবান। এডওয়ার্ড টমসনকে কবি নিজেই সেই সময় বলছেন, ‘আমি সেদিন পর্যন্ত ষাট বৎসরের পূর্ণ যৌবন ভোগ করছিলুম’।
শিলং পাহাড়ের পথে যে রবীন্দ্রনাথকে দিনের পর দিন সপ্তদশী রাণুর সঙ্গে সহাস্যে ভ্রমণরত দেখা গেছে কিংবা কলকাতার রঙ্গমঞ্চে “বিসর্জন” অভিনয়ে অপর্নারূপী রাণুর বিপরীতে জয়সিংহের ভূমিকায় যে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেল, পঞ্জিকার হিসেবে বাষট্টি হলেও যৌবনের দীপ্তিতে তাকে ছাব্বিশই মনে হয়েছিল। রাণু যে এই চিরযুবা রবীরন্দ্রনাথের শুধু ভ্রমণসঙ্গীই হয়েছিলেন তা নয়; কবির একান্ত মনের সঙ্গীতরূপেও ছিলেন দীর্ঘ আট বছর।
রাণুর যৌবনের শ্রেষ্ঠ বসন্তের দিনগুলি শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে তাকে ভালোবেসেই কেটেছিল। উভয়ের প্রতি উভয়ের ভালোবাসায় কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। কিন্তু এই সম্পর্ক উভয়ের মধ্যে কতটা নৈকট্য এনে দেয় তা বলা কঠিন।
অষ্টাদশী রাণুকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘বিধাতা আমাকে অনেকটা পরিমাণে একলা করে দিয়েছেন। কিন্তু তুমি হঠাৎ এসে আমার সেই জীবনের জটিলতার একান্তে যে বাসাটি বেঁধেছ, তাতে আমাকে আনন্দ দিয়েছে। হয়তো আমার কর্মে আমার সাধনায় এই জিনিসটির বিশেষ প্রয়োজন ছিল, তাই আমার বিধাতা এই রসটুকু আমাকে জুটিয়ে দিয়েছেন।’
অষ্টাদশী রাণু রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছে, ‘আমি আপনার কে?” নিজেই বলেছে , “আমি আপনার বন্ধুও নই।” তবে কে? রাণুর উত্তর, ‘আর কেউ জানবেও না।’ এই চিঠিতেই রাণু মনের কপাট খুলে লিখে ফেলেছে, ‘আমি কাউকেই বিয়ে করব না –আপনার সঙ্গে তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার সমস্ত শরীর ছেয়ে সেই আদর আমার মনকে ভরে দিয়েছিল। সেই আদরটুকুতে তো কারুর অধিকার নেই।”
শেষপর্যন্ত রাণু বিয়েতে সম্মত হয় এবং ওই চিঠির সাত মাস পরে রাণু-বীরেন্দ্রের বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিবাহোত্তর জীবনে রাণু “লেডি রাণু মুখার্জ্জী” নামে খ্যাত হন। বিয়ের কদিন আগে রাণুকে ১৫৯ সংখ্যক পত্রে রবীন্দ্রনাথ “তুমি” স্থলে “তুই” সম্বোধন করে উভয়ের সম্পর্কের পূর্ব রেশটুকু ছিন্ন করে ফেলতে চাইলেন। বাহ্যত ছিন্ন করতে চাইলেও রবীন্দ্রনাথ কল্পনায় হয়তো ভেবেছিলেন বীরেন্দ্রের স্ত্রীর মনের আকাশে রবির আলোটুকু বুঝি উজ্জ্বল হয়েই থাকবে।
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো
১৯২৪ সালে পেরুর স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য জাহাজে উঠলেও মাঝপথে অসুস্থ হয়ে আর্জেন্টিনায় অবস্থান করতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সেখানেই পরিচয় হয় ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সাথে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসের এক হোটেলে (প্লাসা হোটেল) ছিলেন তার সহযাত্রী এবং কাজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্টের সাথে। সেখানেই একদিন হাজির হন ওকাম্পো। অবশ্য এমনি এমনি রবাহূত হয়ে রবীন্দ্রনাথের হোটেলে হানা দেননি ওকাম্পো। এর পেছনে একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে।
আসলে প্রথম থেকেই রবীন্দ্র সাহিত্যের গুণমুগ্ধ পাঠক ছিলেন ওকাম্পো। রবীন্দ্রনাথ ততদিনে নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেছেন। তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। একাধিক ভাষায় লিখন এবং পঠনে পারদর্শী ওকাম্পো ইতোমধ্যেই গীতাঞ্জলি পড়ে ফেলেছেন ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফরাসি ভাষায়। গীতাঞ্জলি পড়ে শিহরিত হন ওকাম্পো।
তার নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘তখন আমার গান শেখার সময়। মাদাম ‘র’ তখনো এসে পৌঁছাননি। ধূসর রেশমে আস্তীর্ণ স্বপ্নালোকিত একটি ঘরে পিয়ানোর গায়ে হেলান দিয়ে কবিতাগুলো পড়ছি। শীতকাল। বুয়েনস আইরেসের রাস্তাঘাটের হট্টগোল আমাকে অনুসরণ করে এসেছে, আপাতত চাপা পড়ে গেছে বদ্ধ জানালা আর পর্দার আবরণে। পিয়ানোর পাশে দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছে আমার যৌবনও, ‘আমার ঘরেতে আর নাই সে যে নাই/ যাই আর ফিরে আসি, খুঁজিয়া না পাই/ আমার ঘরেতে নাথ, এইটুকু স্থান/সেথা হতে যা হারায় মেলে না সন্ধান/ অনন্ত তোমার গৃহ, বিশ্বময় ধাম/ হে নাথ, খুঁজিতে তারে সেথা আসিলাম’- কাঁদতে লাগলাম। পড়তে লাগলাম। মাদাম ‘র’ এলেন এবং বিচলিত হয়ে শুধালেন, “কী হয়েছে?” কী করে বোঝাই, হয়নি যে কিছুই! অথচৃ
রবীন্দ্রনাথের কবিতার রীতিমত ভক্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এই সময়টাতে ওকাম্পোর নিজের বৈবাহিক জীবনেও চলছিল নানা টানাপড়েন। তার সদ্য বিবাহিত স্বামী মনেকো এস্ত্রাদার সাথে সম্পর্ক ভাঙ্গনের পথে, এরইমধ্যে স্বামীর এক কাজিন জুলিয়েন মার্টিনেজের সাথে গড়ে উঠেছে ‘সমাজ অস্বীকৃত’ এক ধরনের অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক। ঠিক এই সময়টাতেই রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলি নিয়ে এলেন তার জীবনে। হয়তো গীতাঞ্জলির আধ্যাত্মিক কবিতাগুলো তার টালমাটাল জীবনে কিছুটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যেতে পেরেছিল সে সময়। ওকাম্পো বুঁদ হয়ে রইলেন রবীন্দ্রনাথের লেখায় পরবর্তী কয়েক বছর।
বলে রাখা দরকার, ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো কোনো সাধারণ ললনা ছিলেন না। তিনি ছিলেন আর্জেন্টিনার নারীবাদী লেখিকা এবং ত্রিশের দশক থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করা সুর নামের এক প্রগতিশীল পত্রিকার সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথের সাথে এক ‘রহস্যময়’ প্লেটোনিক ধরনের রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল তার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন ৬৩। আর ওকাম্পোর ৩৪। দিনটি ছিল ১৯২৪ সালের নভেম্বরের একটি দিন। পেরুর যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ বুয়েনস আইরেসের প্লাজা হোটেলে আছেন জেনে তার ‘গুরুদেব’কে এক ঝলক দেখতে এসেছিলেন ওকাম্পো। হোটেলে এসেই সামনে পেলেন রবীন্দ্রনাথের সেক্রেটারি লেনার্ড এলমহার্স্টকে। ওকাম্পোর সাথে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলার পরে এলমহার্স্ট তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিয়ে চলে গেলেন।
সাক্ষাতের মুহূর্তটি ভিক্টোরিয়ার লেখায় উঠে এসেছে ঠিক এভাবে, ‘প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন; নীরব, সুদূর, তুলনাহীন বিনীত। ঘরে এসে দাঁড়ালেন, আবার এও সত্যি যে ঘরে যেন তিনি নেই। তেষট্টি বছর, প্রায় আমার বাবার বয়সী, অথচ কপালে একটি রেখাও নেই, যেন কোন দায়িত্বভারই নষ্ট করতে পারে না তার সোনালী শরীরের স্নিগ্ধতা। সুগোল সমর্থ গ্রীবা পর্যন্ত নেমে এসেছে উছলে-ওঠা ঢেউতোলা সাদা চুলের রাশি। শ্মশ্রুমণ্ডলে মুখের নীচের দিকটা আড়াল, আর তারই ফলে ওপরের অংশ হয়ে উঠেছে আরো দীপ্যমান। মসৃণ ত্বকের অন্তরালে তার সমগ্র মুখাবয়বের গড়ন এক অবিশ্বাস্য সৌন্দর্য রচনা করেছে, তেমনি সুন্দর তার কালো চোখ, নিখুঁত টানা ভারী পল্লব। শুভ্র কেশদাম আর স্নিগ্ধ শ্মশ্রু, এর বৈপরীত্যে জ্বলে উঠছে তার চোখের সজীবতা।
এসেছিলেন কেবল এক ঝলক দেখবার জন্য; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ জেনে অনেকটা জোর করেই তাকে হোটেল থেকে তুলে নেন ওকাম্পো, থাকার বন্দোবস্ত করলেন তার এক আত্মীয়ের বাসায়। বাড়িটির নাম ‘মিরালরিও’। রবীন্দ্রনাথ যেদিন (১২ই নভেম্বর) ওকাম্পোর সঙ্গে তার জন্য নির্ধারিত বাসাটিতে পৌঁছান, সে দিনটি ছিল এমনিতেই একটু অন্যরকম। ওকাম্পোর ভাষ্যমতে, ‘সেই বিকেলে আকাশ ক্রমেই হলুদ হয়ে আসছিল, আর বিশাল ঘন কালো মেঘ। এমন ভয়ঙ্কর গুরু মেঘ, অথচ এমন তীব্র ভাস্বর – কখনো এমন দেখিনি। আকাশ কোথাও সীসার মতন ধূসর, কোথাও মুক্তার মতো, কোথাও বা গন্ধকের মতো হলুদ, আর এতেই আরো তীব্র হয়ে উঠেছে নদীতট, আর তরুশ্রেণির সবুজ আভা। উর্ধ্ব আকাশে যা ঘটেছিল, জলের মধ্যে তাই ফলিয়ে তুলেছিল নদী। কবির ঘরের বারান্দা থেকে দেখছিলাম এই আকাশ, নদী, বসন্তের সাজে ভরা প্রান্তর। বালুচরের উইলো গাছগুলি খেলা করছিল ছোট ছোট হাজারো নম্র পাতায় ঘরে ঢুকতেই ওকে নিয়ে এলাম অলিন্দে, বললাম, নদীটি দেখতেই হবে। সমস্ত প্রকৃতি যেন আমার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে দৃশ্যটাকে করে তুলল পরম রমণীয়। আলোর পাড়ে বোনা প্রবল মেঘপুঞ্জের অন্তরালে কে যেন প্রতিফলক সাজিয়ে ধরেছে আকাশে’।
এই অলিন্দ যেন হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের নিজেরই অলিন্দ। নভেম্বর-ডিসেম্বর এবং জানুয়ারির কয়টি দিন জুড়ে সে অলিন্দে তিনি দেখেছিলেন ‘গোলাপি কুয়াশার আস্তরণে ঢাকা বিকেলগুলি’ আর ফিরে পেয়েছিলেন তার প্রত্যাশিত ‘মন্থর মুহূর্তগুলো। প্লাতা নদীর তীরে এ বিখ্যাত বাড়িতেই হয়তো রচিত হয়েছিল ওকাম্পো আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাঝে সেই ‘রহস্যময় প্রেমের’ নান্দনিক উপাখ্যানগুলো। মিরালরিওর বাসায় যেদিন কবিগুরু পৌঁছেছিলেন সেদিনই রচনা করছিলেন ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা ‘বিদেশী ফুল’।
লেখক: সাংবাদিক, রবীন্দ্র গবেষক
Leave a Reply